সন্দিটঠিকো ভগবতো ধম্মো -

সন্দিটঠিকো- সন্দষ্টিক- স্বয়ং দৃষ্ট বা দর্শনীয়, অর্থাৎ নিজেকে নিজে দেখেন বা উপলব্ধি করেন আন্দাজে অনুমানে, দোদুল্যমানে, শ্রুতময় জ্ঞানে, চিন্তাময় জ্ঞানে বুদ্ধের ধর্ম দর্শন হয় না এমনকি শাস্ত্র বচনে বুদ্ধের ধর্ম হয় না বুদ্ধ ধর্মের চলার পথ দুইটি -

/ বিদর্শন ধূর
/ গ্রন্থধূর
 

প্রাচীনকালে শ্রাবস্তীর দুই বন্ধু তথাগত বুদ্ধের উপদেশে ভিক্ষু ব্রত গ্রহণ করেন পাঁচ বৎসর কাল শাস্তার নিকট অবস্থান করে, বিবিধ বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে তাদের মধ্যে একজন গ্রন্থধূর অনুক্রমে বুদ্ধবচন শিক্ষা লাভ করে যেখানে যান মধুর সুরে ধর্মদেশনা করেন এবং পাঁচশত ভিক্ষুকে  তিনি ধর্ম শিক্ষা দিতেন আটারটি সংঘটনের উপদেষ্টা ছিলেন কিন্তু চরম বিমুক্তি তাহার অধিগত হল না


অপর ভিক্ষু ত্রিপিটক গবেষণা না করে, বুদ্ধের আবিস্কৃত আর্যমার্গে প্রবেশ করে সর্বাত্মক অনুশীলনের মাধ্যমে অচিরেই প্রতিসম্ভিদার সহিত অর্হত্ত্বফল লাভ করলেন বুদ্ধ উভয়ের মন্তব্য শুনে পাণ্ডিত্য অপেক্ষা আচরণই বিশেষ ফলপ্রদ বলে নিম্নের উক্তি দিয়ে উপদেশ প্রদান করলেন -
/ বহুম্পিন চে সহিতং ভাসমানো
     তক্করোহোহি নরো পমোত্ত,
     গেপো' গাবো গনযং পরেসং
     ভাগবা সামঞ্ঞস্' হোতি

     সভাগবা সামঞ্ঞস্' হোতি

বাংলা অনুবাদ - বহু শাস্ত্র জ্ঞান যার বহু অধ্যয়ন
                          অথচ সে শাস্ত্রমতে চলে না কখন,
                          শ্রামণ্য (নির্বাণ) ফলের ভাগী হয় না সে জন,
                         গোপ যথা পর গাভী লভে না কখন

/ অপ্পমিপ চে সহিতং ভাসমানো,
     ধমস্' হোতি অনুধম্মচারী
     রাগঞ্চ দোসঞ্চ পহায মোহং
     সমপ্পজানো সুবিমুত্তোচিত্তো
     অনুপাদিযানো ইধ বা হুরং বা,


অর্থাৎ রাখাল যেমন গৃহস্থের (অন্যের) গরু-গাভী সেবা যত্ন করে গো রসের যথা- দুগ্ধজাত দুধ, দধি, নবনীত দুগ্ধ জাতীয় সুস্বাদু কোন খাদ্য দ্রব্য ভোগ করতে পারেন না, গরুর সম্পদ ভোগ করে একমাত্র মালিক সুতারাং

বাংলা অনুবাদ- অল্প শাস্ত্র জানে কিন্তু শাস্ত্রের মত
                          পালে ধর্মরাগ, দ্বেষ, মোহহীন জন
                          জ্ঞানী মুক্ত চিত্ত উপাদান ত্যাগী
                          উভ'লোকে হন তিনি শ্রামণ্যের (নির্বাণের) ভাগী

যিনি ত্রিপিটক গবেষণা করে ভিক্ষুদের শিক্ষা দিতেন, বুদ্ধ উনাকে রাখালের সাথে তুলনা করেছেন

রাখালেরা যেমন মালিক হতে পারেন না, তেমনি বুদ্ধের ধর্ম পুস্তক আকারে, গবেষণা করে অন্যকে বুঝাতে পারেন তাহারা কোনদিন বুদ্ধের ধর্মের স্বাদ পায়না যিনি অল্পমাত্র শাস্ত্রবাক্য মুখে আবৃতি করেও সেই সমস্ত বাক্যক্তো উপদেশ জীবনে প্রতিপালন করেন এবং রাগ, দ্বেষ মোহ নিরোধ করে সম্যক জ্ঞান লাভের পথে অগ্রসর, সম্যক দৃষ্টি সম্যক সংকল্প পরিপূর্ণ করে প্রজ্ঞালাভে জীবন ধন্য করেন, বিমুক্ত চিত্ত হন, উপাদান সমূহ - কাম, ভব, ভ্রান্ত দৃষ্টি ইত্যাদি আসক্তি শুন্য করতে পারেন, তিনিই ইহলোকে এবং পরলোকে বুদ্ধের শিষ্যত্বের ভাগী হয়ে থাকেন

বুদ্ধ উনার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- "এই ভিক্ষু ইহকাল পরকাল বুদ্ধের দাতা, দায়ক, ধর্মের অধিপতি, ধর্মের ধারক বাহক এবং বুদ্ধ ধর্মের সদ্ধর্ম রশ্মি বুদ্ধের ধর্ম অন্য কাউকে দিতে চাইলে তিনিই পারবেন"

যেমন, আর্য না হলে আর্যসত্য বোঝা বোঝানো দুরূহ ব্যাপার তেমনি যাহারা কখনো ধর্মের উচ্চ অবস্থা লাভ করতে পারেন না তাহারা অন্যকেও উচ্চ অবস্থান লাভ করতে সক্ষম হন না

বুদ্ধের ভাষায় "চতুসচ্চং বিনিমুত্তং ধম্ম নামনত্থি"
চারি আর্যসত্য বিহীন বুদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব নাই, চারি আর্যসত্য দর্শন না হলে বুদ্ধের ধর্ম দর্শন হয় না
সে চারি আর্যসত্য হলো- দুঃখ, দুঃখ সমুদয় বা কারণ দুঃখ নিরোধ দুঃখ নিরোধের উপায়


 দুঃখ - চারি অপায় দুঃখ, চারি আর্যসত্যের প্রথম আর্যসত্য দুঃখ তাই ভাবনাকারীদের শুরুতেই এই দুঃখ আর্যসত্য দর্শন হয় নিজেই দেখে, নিজের ভেতর দুঃখ জমা আছে, ইহাই দুঃখ আর্যসত্য

যদি কেহ বুদ্ধের ধর্ম বিশুদ্ধভাবে আচরণ (বিদর্শন ভাবনা) করে চলেন, তবে তাহার প্রথম দর্শন কায়দ্বারে, বাক্যদ্বারে মনোদ্বারে দুঃখ উপলব্ধি হবে বিদর্শন ভাবনা চর্চায় প্রথমে দুঃখ অনুভূত হয়, যেমন- শরীরের যে কোন অংশে ব্যথা-বেদনার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় অবশ্য সবার ক্ষেত্রে একই রকম হয়না কারণ এক একজনের জমাকৃত কর্ম ভিন্ন ভিন্ন, সুতারাং বিভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে

যথা - ব্যথা, টানানি, কনকনানি, ঝিনঝিনানি অনেক সময় শরীরে গরম-শীত অনুভূত হয় অনাকাঙ্ক্ষিত স্বাদ-আস্বাদ পাওয়া যায় আরো অনেক কিছু অনুভূত হয় যা একমাত্র বিদর্শন ভাবনাকারীরাই জ্ঞাত

প্রথমে এই দুঃখ লক্ষণ দর্শন হয় কেন? নির্বাণ যেতে হলে প্রথমে বুদ্ধের প্রথম মার্গ "স্রোতাপন্ন" হতে হবে "স্রোতাপন্ন" লাভ করতে হলে চারি অপায় কর্ম বিপাক ক্ষয় করিতে হইবে বুদ্ধের ভাষায় "চতু অপায়"

নিজের উপলব্ধি কাহারো নিকট জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন নেই, নিজেকে দেখা

দুঃখ নিরোধ দর্শনে আচরণকারী তাহা হইতে বিমুক্তির মানসে চেষ্টা করেন ইহা জ্ঞাত হয়ে এবং বুদ্ধ নিয়মে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ ব্যবহার করেন তাহাতে সম্যক বাক্য ব্যবহারের কারণে আলম্বন বা নিমিত্ত সৃতিপট হতে অপসারণ হয় যাহা জন্ম-জন্মান্তরের কর্মবিপাক ক্ষীণ শেষ হইতে আরম্ভ করে অবশেষে তাহা ক্ষয় হয় জমাকৃত কর্ম নিরোধ হবার উৎকৃষ্ট পথ এবং ইহা দুঃখ নিরোধের উপায়

চক্রবালে সমস্ত প্রাণীর শরীরে অনন্ত অনন্তবার- নরক, অসুর, প্রেত তির্যক কুলে জন্মগ্রহণের যে কর্মবিপাক জমা আছে, তাহা জ্ঞাত বা দর্শন হয়, চতুরার্য সত্যের দুঃখের কারণ দর্শন, অন্য প্রাণীরা তা বুঝতে পারেনা একমাত্র তা বুঝতে পারে বিধায় মানবের সদ্ধর্ম

বিদর্শন ভাবনায় ভাবনাকারী যদি সঠিক আচরণের মাধ্যমে ভাবনা করে এবং প্রথম দুঃখ লক্ষণ দর্শনে নিজেকে সেভাবে টিকিয়ে রাখতে পারলে (শুদ্ধভাবে চালিয়ে যাওয়া) ভাবনাকারী উপরের ধ্যানে উপনীত হয় যে কোন রকমের আলম্বন সৃষ্টি হলে, তা স্মৃতির মাধ্যমে নিরোধ করিতে হয় যাহা নিজের উপলব্ধি হয় বা জ্ঞান পরিপূর্ণ হয় নিজের কর্ম বিপাক নিরোধ বা ক্ষয় হতে নিজে নিজে দেখেন এবং অনুভব করতে পারেন নিজেকে স্তর স্তর উন্নীত হতে দেখেন এবং জ্ঞানী হতে পারেন, ইহাই দুঃখের নিরোধ


যতই বাক্য দ্বারা ব্যবহার করা যায়, ততই বিপাক ক্ষয় হয় পদ্ধতি শুদ্ধতার কারণে চর্চা শুদ্ধ হয় নিজে নিজে তা অনুধাবন করে বিধায় ভাবনাকারী জানিতে বুঝিতে পারে যে ইহাই দুঃখ নিরোধের উপায়


                                                           

এই চারি আর্যসত্য দর্শন হেতু শরীরের ভিতরে বাহিরে এমনকি একত্রিশ লোকভুমিও দর্শন করা যায় সত্যিকারের ধর্মাচরণকারীরা ইহা দর্শন স্বয়ং দৃষ্ট হয়ে অনিত্য সৃষ্টি করতে সমর্থ যাহা দেখা যায় বা উপলব্ধি করা যায় তাহাই জ্ঞান সেই জ্ঞান অন্য জ্ঞানের চাইতে শ্রেষ্ঠ সর্ব প্রকার জ্ঞান হইতে শ্রেষ্ঠ তাহাই "সন্দিটঠিকো"
                                               নির্বাণ পরম সুখ
                                               সকল প্রাণী সুখী হোক


বিঃ দ্রঃ - বিদর্শন ভাবনা চলাকালীন দেশনার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের আলোকে এবং উৎস গ্রন্থ- সদ্ধর্ম পরিচিতি বিদর্শনাচার্য তেমিয়ব্রত বড়ুয়া চলমান........